Md. Safur Meah Computer Operator Rangunia Government College, Chattogram.

স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর নেই

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।  শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। গত ২৮ নভেম্বর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন। ২২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তার মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আর্মি স্টেডিয়ামেই নামাজে জানাজা সম্পন্ন হবে। জানাজার পর ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
বাংলাদেশের ব্র্যাক আজ সারা বিশ্বে পরিচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত এনজিও। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণমূলের মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ।
৮৩ বছর বয়সে চলতি বছর স্যার আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তাঁকে প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস চেয়ার নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করার পর তা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন ভূস্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকরিস্থলে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সঙ্গে পাবনায় চলে যান । তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা বাদ দিয়ে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একাত্তর খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি ব্র্যাক গড়ে তোলেন। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। দরিদ্র মানুষ যাতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি তাঁর কর্মসূচি পরিচালনা করেন। চার দশকের মধ্যে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটান। ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহত্ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে। 
বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) থেকে ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন। 
২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'ওয়াইজ প্রাইজ' লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র্য-বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি 'নাইটহুড' লাভ করেন। এছাড়া ২০০৭ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'স্বাধীনতা পুরস্কার' এবং ২০০৮ সালে মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিট্যারিয়ান অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করেন। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার রয়েছে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে। অশোকা ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম 'গ্লোবাল গ্রেট' স্বীকৃতিতে ভূষিত করেছে।
এ ছাড়া তিনি ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৮), ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ (২০০৭), দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা (২০০৭), গেটস্ অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল এনট্রাপ্রেনিওরশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০২), ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯২), অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০), ইউনেসকো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ (১৯৮০) লাভ করেন।
মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্ববৃহত্ পুরস্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিট্যারিয়ান অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০০৭) অর্জন করেছে।
ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১৪), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১২), যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০১০), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯), যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটার্স (২০০৭), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন (২০০৩), কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (১৯৯৪) উল্লেখযোগ্য।

অশোকা ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করেছে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ‘গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল এনট্রাপ্রেনিওরশিপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের মহাপরিচালক বান কি মুন ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গে’র একজন হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

No comments

Powered by Blogger.